জন স্টুয়ার্ট মিলের “On Liberty” (১৮৫৯) আধুনিক গণতন্ত্র ও ব্যক্তি স্বাধীনতা নিয়ে লেখা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এই গ্রন্থে তিনি যুক্তি দেন যে, একজন ব্যক্তি যতক্ষণ না অন্যের ক্ষতি করছে, ততক্ষণ তার স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করা উচিত নয়। তিনি মূলত মত প্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেছেন। মিলের মতে, একটি সমাজ তখনই উন্নত হতে পারে, যখন ব্যক্তি মুক্তভাবে তার চিন্তা ও মতামত প্রকাশ করতে পারে।
জন স্টুয়ার্ট মিলের স্বাধীনতা বিষয়ক দর্শনের মূল ভিত্তি হলো ‘হার্ম প্রিন্সিপল’ বা ‘ক্ষতির নীতি’। তিনি মনে করেন, একজন ব্যক্তি তার ইচ্ছামতো কাজ করতে পারে, যতক্ষণ না তা অন্যের ক্ষতি করছে। রাষ্ট্র বা সমাজ তখনই হস্তক্ষেপ করতে পারে, যখন কোনো ব্যক্তির কর্মকাণ্ড অন্যের জন্য ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। মিল বলেন, “The only freedom which deserves the name is that of pursuing our own good in our own way, so long as we do not attempt to deprive others of theirs, or impede their efforts to obtain it.” অর্থাৎ, ব্যক্তি তার স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে, তবে তার স্বাধীনতা অন্য কারও অধিকারে হস্তক্ষেপ করলে তা সীমাবদ্ধ করা যেতে পারে।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেন অপরিহার্য, তা ব্যাখ্যা করতে মিল তিনটি গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি প্রদান করেন। প্রথমত, তিনি মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সত্য ও মিথ্যার পরীক্ষার ক্ষেত্র হিসেবে দেখান। যদি কোনো মত সত্য হয়, তবে সেটাকে দমন করা মানবজাতিকে সত্য জানার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার শামিল। আবার, যদি কোনো মত ভুল হয়, তবুও সেটাকে প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে, যাতে সমাজ বুঝতে পারে কেন তা ভুল। উদাহরণস্বরূপ, গ্যালিলিও যখন বলেছিলেন যে পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে, তখন চার্চ সেটাকে ভুল বলে দমন করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে প্রমাণিত হয় যে গ্যালিলিওর বক্তব্যই সঠিক ছিল। যদি তখন মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকত, তাহলে সত্য আরও দ্রুত প্রকাশ পেত।
দ্বিতীয়ত, মিল মনে করেন যে অনেক সময় কোনো মত সম্পূর্ণ ভুল না হয়ে আংশিক সত্য হতে পারে। বিতর্কের মাধ্যমে এই আংশিক সত্য আলাদা করা সম্ভব। প্রাচীনকালে মানুষ ভাবত যে শুধুমাত্র অভিজাতদের শাসন করা উচিত। গণতন্ত্রের ধারণা তখন অসম্পূর্ণ মনে হলেও, সময়ের সাথে তা গ্রহণযোগ্য হয়েছে। ফলে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হলে সমাজের চিন্তার বিকাশ ঘটে এবং মানুষ নতুন নতুন ধারণা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়।
তৃতীয়ত, মত প্রকাশের স্বাধীনতা সমাজকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সমৃদ্ধ করে। যদি মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকে, তবে মানুষ নিজের বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তুলতে ভয় পাবে এবং সমাজে বুদ্ধিবৃত্তিক স্থবিরতা (Intellectual Stagnation) আসবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মধ্যযুগে ইউরোপে চার্চের শাসনে মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকায় বিজ্ঞান ও দর্শনের অগ্রগতি থেমে গিয়েছিল। কিন্তু রেনেসাঁ এবং আলোকপ্রাপ্তির যুগে (Enlightenment) এই স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার হলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়।
তবে মিল মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর নিরঙ্কুশ অধিকার দেননি। তিনি মনে করেন, রাষ্ট্র তখনই মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে, যখন তা অন্যের ক্ষতি করতে পারে। তিনি বলেন, “The liberty of the individual must be thus far limited; he must not make himself a nuisance to other people.” অর্থাৎ, ব্যক্তি স্বাধীনতার চর্চা করতে পারে, তবে সেটি যদি অন্যের জন্য ক্ষতিকর হয়ে ওঠে, তাহলে তা নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। যেমন, কেউ যদি জাতিগত বা ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ায় (Hate Speech), তবে তা নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। কিন্তু কেউ যদি শুধুমাত্র সরকারের সমালোচনা করে, তবে তা দমন করা উচিত নয়।
আজকের যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সেন্সরশিপের প্রসঙ্গেও মিলের মতবাদ প্রাসঙ্গিক। বর্তমানে Facebook, Twitter, YouTube ইত্যাদি প্ল্যাটফর্ম অনেক সময় মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত করছে। Hate Speech ঠেকানোর নামে অনেক সময় রাজনৈতিক মতামতও দমন করা হয়। ফলে প্রশ্ন জাগে, এটি কি মিলের “On Liberty” এর নীতির পরিপন্থী? একইভাবে, অনেক দেশ ‘জাতীয় নিরাপত্তার’ অজুহাতে সংবাদমাধ্যম ও ইন্টারনেটে মত প্রকাশ নিয়ন্ত্রণ করে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, এই সীমাবদ্ধতা কি আসলেই জনগণের জন্য ভালো, নাকি সরকারের সুবিধার জন্য? এসব প্রশ্নের উত্তর মিলের ‘হ্যার্ম প্রিন্সিপল’-এর আলোকে বিচার করলে বোঝা যায়, মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি, তবে এটি অবশ্যই অন্যের ক্ষতি না করার শর্তে বজায় রাখতে হবে।
“On Liberty”–এর মূল ধারণার সমালোচনা
তবে, এই গ্রন্থের কিছু অংশ বিশেষভাবে সমালোচিত হয়েছে, বিশেষত ব্যক্তি স্বাধীনতা বনাম সামাজিক দায়িত্বের সীমারেখা নির্ধারণের ক্ষেত্রে। বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তির বিকাশ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উত্থান, এবং রাষ্ট্রীয় নজরদারির প্রসার On Liberty–এর নীতিগুলোর কতটা প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক তা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
১. “হার্ম প্রিন্সিপল” ও বাস্তব জটিলতা
মিলের মূল নীতি ছিল ‘ক্ষতির নীতি’ (Harm Principle)—যেখানে তিনি যুক্তি দেন, “একজন ব্যক্তি যা ইচ্ছা করতে পারে, যতক্ষণ না তা অন্যের ক্ষতি করছে” (The only freedom which deserves the name is that of pursuing our own good in our own way, so long as we do not attempt to deprive others of theirs, or impede their efforts to obtain it.)। এই যুক্তিটি তাত্ত্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য হলেও বাস্তবে এটি প্রয়োগ করা জটিল।
প্রশ্ন হলো, কীভাবে নির্ধারণ করা হবে যে কোনো কাজ অন্যের ক্ষতি করছে কি না? মিল সরাসরি বলেননি যে “ক্ষতি” কেবল শারীরিক বা আইনি হতে হবে, নাকি সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিকও হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘৃণাসূচক বক্তব্য দেয়, তবে তা সরাসরি শারীরিক ক্ষতি করে না, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়াতে পারে। মিলের দর্শন এই ধরণের জটিল সামাজিক বাস্তবতায় অস্পষ্ট থেকে যায়।
২. ব্যক্তি স্বাধীনতা বনাম সামাজিক দায়বদ্ধতা
মিল ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণকে সীমিত রাখতে চেয়েছেন। তিনি মনে করতেন যে, সমাজের জন্য ব্যক্তি স্বাধীনতা অপরিহার্য এবং সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। কিন্তু এই দর্শনের একটি মূল সমস্যা হলো, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা।
আজকের পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তন, জনস্বাস্থ্য সংকট (যেমন COVID-19), এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের মতো বিষয়গুলোতে কেবল ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর জোর দিলে সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি উপেক্ষিত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ নিজের ইচ্ছেমতো মাস্ক না পরে বা টিকা না নেয়, তাহলে তা তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অংশ, কিন্তু একইসঙ্গে এটি অন্যদের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলে। মিলের দর্শন এই প্রসঙ্গে কতটা কার্যকর তা প্রশ্নবিদ্ধ।
৩. মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ভ্রান্ত ধারণার বিস্তার
মিল বলেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা উচিত, কারণ সত্য ও মিথ্যার লড়াইয়ে সত্যই জয়ী হবে। তিনি বলেন, “যদি কোনো মত সত্য হয়, তবে সেটাকে দমন করা মানে মানবজাতিকে সত্য জানার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা।” কিন্তু বর্তমান সময়ে আমরা দেখি যে, মিথ্যা তথ্য এবং ষড়যন্ত্রতত্ত্ব (Conspiracy Theories) অনলাইনে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং তা সত্যকে আড়াল করতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, করোনাভাইরাস সম্পর্কে ভ্রান্ত তথ্য বা রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সহজেই প্রচারিত হয় এবং অনেক মানুষ তা বিশ্বাস করে। মিলের সময়ের তুলনায় এখন তথ্য প্রবাহ এত দ্রুত যে কেবল যুক্তির মাধ্যমে সত্য প্রতিষ্ঠা করা সবসময় সম্ভব হয় না। এই ক্ষেত্রে, তার মত প্রকাশের স্বাধীনতার ধারণা কিছুটা সীমিত বলে মনে হতে পারে।
আধুনিক সময়ে এর প্রাসঙ্গিকতা ও অপ্রাসঙ্গিকতা
১. গণতন্ত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা
আধুনিক গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি মত প্রকাশের স্বাধীনতা, যা মিলের দর্শনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অনেক দেশে সরকার বিরোধী কণ্ঠ দমন করা হয়, যা মিলের যুক্তির পরিপন্থী। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়া বা চীনের মতো দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান, যেখানে সরকার বিরোধী মতামত প্রকাশ করা কঠিন।
তবে, পশ্চিমা দেশগুলোতেও ‘কান্সেল কালচার’ (Cancel Culture) এবং রাজনৈতিক সঠিকতার (Political Correctness) কারণে অনেক সময় উন্মুক্ত বিতর্কের সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে। মিলের দর্শন অনুসারে, সমাজে সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সব মতামতের মুক্ত প্রবাহ প্রয়োজন, কিন্তু বর্তমানে সেটি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
২. প্রযুক্তি ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা
মিল রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কমানোর পক্ষে ছিলেন, কিন্তু আজকের যুগে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর অতি-শক্তিশালী ভূমিকা তাকে নতুনভাবে চিন্তিত করত। Facebook, Google, এবং অন্যান্য প্রযুক্তি সংস্থা আমাদের তথ্য সংগ্রহ করছে এবং আমাদের মতামত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ফলে, এখন প্রশ্ন ওঠে—এই কোম্পানিগুলো কি একধরনের আধুনিক ‘নির্বাচিত সরকার’ হিসেবে কাজ করছে? মিল ব্যক্তি স্বাধীনতার পক্ষে থাকলেও, এই নতুন বাস্তবতায় কীভাবে তা কার্যকর হবে, তা অনিশ্চিত।
৩. জাতীয় নিরাপত্তা বনাম স্বাধীনতা
অনেক দেশে জাতীয় নিরাপত্তার নামে নাগরিকদের স্বাধীনতা সংকুচিত করা হয়। সন্ত্রাসবাদ দমনের জন্য নজরদারির বৃদ্ধি, ইন্টারনেট সেন্সরশিপ, এবং গণতন্ত্রের নামে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন এখন সাধারণ ঘটনা। মিলের দর্শন অনুযায়ী, এটি স্বাধীনতার পরিপন্থী, কিন্তু আধুনিক বিশ্বে নিরাপত্তা এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার মধ্যে সমন্বয় করা চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে।
শেষ কথা
জন স্টুয়ার্ট মিলের On Liberty আজও মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ব্যক্তি অধিকারের অন্যতম মৌলিক দর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি গণতন্ত্রের ভিত্তি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার পক্ষে একটি শক্তিশালী যুক্তি প্রদান করেছে। তবে, প্রযুক্তির বিকাশ, রাষ্ট্রীয় নজরদারি, এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার পরিবর্তিত সংজ্ঞার কারণে এটি সম্পূর্ণ প্রাসঙ্গিক নয়।
বর্তমান বিশ্বে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে উঠেছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা দরকার, কিন্তু সেটির অপব্যবহার রোধ করাও জরুরি। একইভাবে, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কমানো প্রয়োজন, কিন্তু প্রযুক্তি কোম্পানির মতো নতুন শক্তিগুলোর ভূমিকা নিয়ন্ত্রণ করাও গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং, On Liberty আজও আমাদের ভাবনার খোরাক জোগায়, তবে একে আধুনিক বাস্তবতার আলোকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করাও সমান জরুরি।