রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী ও বিজ্ঞানমনস্কতা

প্রাচীন কালে প্রাকৃতিক দুর্যোগকে মানুষ বিধাতার অভিশাপ ভাবত। রবীন্দ্রনাথের সময়েও অনেকেই তেমন ভাবতেন। এখনও কোথাও ভূমিকম্প বা সুনামি হলে অনেকে সেটিকে দেবতার অভিশাপ বলে মনে করেন—যদিও বৈজ্ঞানিক যুক্তির ভিত্তিতে এ দাবি ধোপে টেকে না।

রবীন্দ্রনাথ বৈজ্ঞানিক নন, তিনি সাহিত্যিক। সাধারণভাবে আমরা ধরে নিই সাহিত্যিকরা যুক্তিবিদ্যার ধার ধারেন না, তারা আধ্যাত্মিকতা নিয়ে নিমগ্ন থাকেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী এবং তার্কিক। সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সামাজিক কুসংস্কার বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আজও প্রাসঙ্গিক।

১৯৩৪ সালে বিহারে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়—রিখটার স্কেলে ৮.০ মাত্রা; প্রাণহানি ১২ হাজারেরও বেশি। সবাই হতবাক—মহাত্মা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথও বিচলিত হন, কিন্তু তাঁদের প্রতিক্রিয়া ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।

তৎকালীন ভারতীয় সমাজে শূদ্রদের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণদের অস্পৃশ্যতার অত্যাচার ছিল ব্যাপক। মহাত্মা গান্ধী এ সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি দেখে গান্ধী বলেন—অস্পৃশ্যতা একটি পাপ; এই পাপের ফলেই ঈশ্বরের অভিশাপ হিসেবে এসেছে ভূমিকম্প।

রবীন্দ্রনাথও অস্পৃশ্যতার বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু তিনি সমাজে যুক্তিহীনতা ছড়াতে রাজি নন—even যদি উদ্দেশ্য সৎ হয় তবুও। তাঁর মতে, এভাবে অযুক্তির বীজ বপন করলে মানুষ যুক্তিবর্জিত হয়ে পড়ে, যা সমাজের অগ্রগতির পথে অন্তরায়।

তিনি গান্ধীজিকে চিঠিতে লেখেন—প্রাকৃতিক ঘটনার পেছনে থাকে জাগতিক কারণ; সেখানে দৈবশক্তির হস্তক্ষেপ খোঁজা অযৌক্তিক। এই ধরনের চিন্তা আমাদের অন্ধ করে এবং আত্মানুসন্ধানের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

গান্ধীর যুক্তি অনুসারে বলতে হয়, ঈশ্বর বিহারের সবাইকে এক পাল্লায় মাপছেন—নিষ্পাপ শিশু, শূদ্র, গোবাদি পশু—সবাই সমান শাস্তি পাচ্ছে! অথচ অন্যান্য প্রদেশের পাপীরা অক্ষত থাকছে।

এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেন—যাদের হাতে কুসংস্কার দূর করার দায়িত্ব, তারাই যদি কুসংস্কার ছড়ায় তাহলে সমাজের অগ্রগতি কীভাবে সম্ভব?

কৈশোরে শারদীয় দেশ পত্রিকায় এই বিতর্ক নিয়ে লেখা পড়েছিলাম। সম্প্রতি অমর্ত্য সেনের আত্মজীবনীতে সেই বিখ্যাত চিঠি বিনিময়ের গল্প আবার পড়ে মনে পড়ে গেল।

আমাদের সৌভাগ্য, আমরা রবীন্দ্রনাথ পেয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমরা তাঁকে ধারণ করতে পারিনি। আমরা পুরোনো ভুল তত্ত্ব আঁকড়ে ধরে থাকি, নতুন সত্য গ্রহণে দ্বিধা করি।

আজ আমরা জানি, টেকটোনিক প্লেটের গতির জন্য ভূমিকম্প হয়। ভবিষ্যতে অন্য কোনো তত্ত্ব এলে সেটাকেই সত্য বলে মানব। প্রাচীন কোনো তত্ত্বকে ধ্রুব সত্য ভাবার যৌক্তিকতা নেই।

এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—

কতকগুলি নির্দিষ্ট মতবাদ, কাহিনী ও আচারকে ধ্রুব সত্য বলিয়া ছাত্রদের মনে সংস্কারবদ্ধ করিয়া দিলেই যথোচিত ধর্মশিক্ষা দেওয়া হয় না। যাহা জীবনের সামগ্রী তাহা বাড়িবে, তাহা চলিবে। তাহা ডোবা নহে, বাঁধানো সরোবর নহে, তাহা কালের ক্ষেত্রে ধাবিত নদী।

মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—

পূর্বপুরুষের পুনরাবৃত্তি করা মনুষ্যধর্ম নয়।… জাতিভেদ, ধর্মবিরোধ, মূঢ় সংস্কারের আবর্তে যত দিন আমরা চালিত হতে থাকব, ততদিন কার সাধ্য আমাদের মুক্তি দেয়! বাহিরের শত্রুর সঙ্গে সংগ্রাম করতে তেমন বীর্যের দরকার হয় না, আপন অন্তরের শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করাতেই মনুষ্যত্বের চরম পরীক্ষা।

নতুন জ্ঞানের বিকাশ ও পুরনো কুসংস্কারের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলতে যুক্তি-তর্কের কোনো বিকল্প নেই। গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের এই বিতর্ক তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্ককে বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ করেনি। তাই তাঁদের জীবনদর্শন আজও আমাদের জন্য চিন্তা উদ্দীপক ও চিত্তাকর্ষক।

অভিজিৎ দেব
অভিজিৎ দেব
প্রবাসী লেখক ও গবেষক, নন-ফিকশন পাঠক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *