১. শিল্পের অন্তঃস্থল: ‘বিশেষ’ থেকে ‘নৈর্ব্যক্তিক’ হওয়া
শিল্প আসলে কী? এটি কি কেবল শিল্পীর আত্মপ্রকাশের এক মাধ্যম, নাকি তা এক বৃহত্তর মানবিক পরিসরের অংশ, যেখানে ব্যক্তি অভিজ্ঞতা রূপান্তরিত হয় সমষ্টির অভিজ্ঞতায়? এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই নিহিত রয়েছে শিল্পের অন্তর্নিহিত শক্তি ও সৌন্দর্য—যেখানে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, অনুভব ও স্মৃতির রূপান্তর ঘটে সামষ্টিক চৈতন্যে। যেখানে ‘বিশেষ’ হয়ে উঠে ‘নির্বিশেষ’ বা ‘নৈর্ব্যক্তিক’।
শিল্প কেবল আবেগপ্রসূত প্রকাশ নয়, বরং এটি এক বিশ্লেষণযোগ্য কাঠামো—যাকে বিচার করা যায় নানান দৃষ্টিকোণ থেকে: শৈল্পিক নৈপুণ্য, বিষয়বস্তু ও ভাবের গভীরতা, সৌন্দর্যবোধ, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তার মানবিক ও নৈতিক স্পর্শ কতটা সার্বজনীনভাবে অনুরণিত হতে পারে। শিল্পের সফলতা এখানেই যে, তা দর্শকের মনে কতটুকু অনুরণন সৃষ্টি করতে পারে, কতটুকু স্মৃতি, অভিজ্ঞতা ও চেতনার সাথে সংযোগ ঘটাতে পারে। এ কারণেই শিল্পের প্রকৃত উদ্দেশ্য শুধু সৌন্দর্য সৃষ্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং সেটি একটি নির্দিষ্ট, পার্টিকুলার (বিশেষ) অভিজ্ঞতা থেকে উত্তীর্ণ হয়ে এক নৈর্ব্যক্তিক, ইউনিভার্সাল চেতনার পরিসরে পৌঁছাতে চায়—যেখানে প্রত্যেকেই খুঁজে পান নিজস্ব ব্যাখ্যা, অথচ তা একটি সম্মিলিত মানবিক উপলব্ধির অংশ হয়ে ওঠে।
এখানে, ‘বিশেষ’ মানে হলো একটি নির্দিষ্ট সময়, স্থান, শ্রেণি বা সংস্কৃতির ভেতরে জন্ম নেওয়া কোনো অভিজ্ঞতা বা উপলব্ধি। উদাহরণস্বরূপ, কোনো গ্রামের কৃষকের দুর্ভিক্ষের স্মৃতি বা শহরের কর্মজীবী নারীর যান্ত্রিক জীবনের গল্প—এইসবই ‘বিশেষ’। এগুলোর প্রেক্ষিত, ভাষা, অনুভব—সব কিছুই প্রাথমিকভাবে সীমিত। কিন্তু সেই সীমিত অভিজ্ঞতাকে যখন এমনভাবে প্রকাশ করা হয় যাতে তা শ্রোতা বা পাঠকের কাছে নিজের অভিজ্ঞতার মতোই মনে হয়, তখনই তা ‘নৈব্যক্তিক’ হয়ে ওঠে—ব্যক্তিক পরিচয়ের সীমা ছাড়িয়ে এক সর্বজনীন সত্তায় (particular to universal) পৌঁছে যায়। তখন একজন কবির বেদনা হয়ে ওঠে সর্বজনের ব্যক্তিগত আত্মোপলব্ধি, একজন চিত্রশিল্পীর স্মৃতি হয়ে ওঠে সর্বজনের ব্যক্তিগত আবেগ।
শিল্পীর মনে প্রতিটি শিল্পকর্মের জন্ম হয় কোনো না কোনো ব্যক্তিগত অনুভব, নিজস্ব অভ্যন্তরীণ যাপন, প্রশ্ন বা বেদনা থেকে। শিল্পী মনের এইসব অভ্যন্তরীণতা—চিন্তার গভীরতা, স্মৃতির রং, কিংবা জীবনের তীব্র কোনো অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ—এগুলিই মূলত শিল্পের মূল অনুপ্রেরণা। একজন কবি যখন কোনো কবিতা রচনা করেন, একজন চিত্রকর যখন তুলি হাতে তুলে নেন, কিংবা একজন সুরকার যখন সংগীতের ঘনঘটায় হারিয়ে যান—তখন তিনি মূলত নিজের ভেতরের একান্ত অনুভূতিকেই প্রকাশ করতে চান। সেই মুহূর্তে তিনি বিশেষ, একক, আলাদা। তাঁর অনুভব, যাপন, বেদনা কিংবা আনন্দ—সবই স্বকীয়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেই একান্ত অনুভূতির শিল্পরূপ কি কেবল শিল্পীর নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে? যদি তা-ই হয়, তাহলে সেই শিল্প কখনোই আত্মাকে ছুঁতে পারে না, শ্রোতার মনে ঢেউ তুলতে পারে না, পাঠকের চোখে জল আনতে পারে না। প্রকৃত শিল্পী নিজের বিশেষ অভিজ্ঞতাকে এমনভাবে নির্মাণ করেন, এমন ভাষায় রূপ দেন, এমন রূপক ও প্রতীকের আশ্রয় নেন—যা শিল্পীর নিজের বিশেষ অভিজ্ঞতাকে নৈর্ব্যক্তিক করে তোলে। যখন একটি কবিতা কেবল কবির নয়, পাঠকেরও অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে, তখন সে হয়ে ওঠে শিল্প। যখন একটি চিত্রকর্ম দেখে কেউ নিজের মায়ের মুখ কল্পনা করেন, যদিও চিত্রশিল্পী হয়তো এঁকেছিলেন নিজের শৈশবের স্মৃতি, তখনই বোঝা যায়—শিল্প তার সীমানা পেরিয়েছে। এই সীমা অতিক্রম করাটাই নৈর্ব্যক্তিকতা।
এটি কোনো নিরস বস্তুনিরপেক্ষতা নয়। বরং, এটি একধরনের জাগ্রত সামষ্টিকতা—যেখানে শিল্পীর একান্ত অনুভব হয়ে ওঠে সকলের অভিজ্ঞতা। একটি বিশেষ অনুভূতি এমনভাবে নির্মাণ করা, যাতে সেটি হাজারো হৃদয়ে অনুরণিত হয়—এই কুশলতাই নৈর্ব্যক্তিকতার শিল্প।
এই রূপান্তর—ব্যক্তিগত থেকে সামষ্টিকের দিকে, বিশেষ থেকে নির্বিশেষের দিকে—শিল্পের সবচেয়ে সূক্ষ্ম কুশলতা। এই কুশলতা ছাড়া শিল্প মানুষের মন ছুঁতে পারে না, হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করতে পারে না।
এখানে একটি বিপরীতধর্মী সত্যও রয়েছে। শিল্প যখন সত্যিকার অর্থে বিশেষ হয়—অর্থাৎ আন্তরিক, সৎ ও গভীরভাবে অনুভূত—তখনই তার ভিতর থেকে উঠে আসে নির্বিশেষ। কারণ মানুষ যতই বিচিত্র হোক, আমাদের অনুভূতির মূলতত্ত্বগুলো অভিন্ন: ভালোবাসা, শোক, আকাঙ্ক্ষা, বিভ্রম, বিস্ময়। একজন শিল্পী যদি সৎ থেকে সেই বিশেষ অনুভবকে তুলে ধরেন, তবে তাতে অসংখ্য পাঠক নিজের ছায়া খুঁজে পান।
এই দ্বৈততা—বিশেষের মধ্যে নির্বিশেষকে ধারণ করার ক্ষমতা—শিল্পকে চিরন্তন করে তোলে।
তবে শিল্পে, শিল্পীর পরিপূর্ণ অধিকার বা দখল না থাকলে, বিশেষের মধ্যে নির্বিশেষকে ধারণ করার যে ক্ষমতা— যা মূলত নৈর্ব্যক্তিকতা, এবং যা মূলত শিল্পকে চিরন্তন করে তোলে; তা অসম্ভব হয়ে উঠে।
“শিল্পে শিল্পীর পরিপূর্ণ অধিকার” বিষয়টি শুধু একটি নৈতিক বা ব্যক্তিগত দাবির জায়গা নয়, বরং এটি শিল্পের উৎপত্তি, প্রাসঙ্গিকতা ও শক্তির কেন্দ্রবিন্দু। এই অধিকার মানে হলো—একজন শিল্পী তাঁর অনুভব, মতাদর্শ, ভাষা, চিন্তা, অভিজ্ঞতা এবং কল্পনার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখবেন, এবং কোনো বাহ্যিক চাপ বা অনুমোদন ছাড়াই তা প্রকাশ করতে পারবেন।
শিল্প সৃষ্টি হয় শিল্পীর গভীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, অনুভূতি, প্রশ্ন ও প্রতিবাদ থেকে। তা সে কবিতা, ছবি, সঙ্গীত, নাটক বা চলচ্চিত্র—সবই এক অর্থে শিল্পীর আত্ম-প্রকাশ।
যদি তিনি নিজের অভ্যন্তরীণ জগতের উপর নিয়ন্ত্রণ হারান, তবে শিল্প তার প্রাণ হারায়।
এ প্রসঙ্গে ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ বলেন:
I am seeking. I am striving. I am in it with all my heart.
এখানে “I” –– অর্থাৎ শিল্পীর নিজস্ব যাপন ও দর্শনই শিল্পের চালিকাশক্তি।
একটু আগেই শিল্পে, শিল্পীর পরিপূর্ণ অধিকারের কথা বলেছি। পরিপূর্ণ অধিকার মানে এখানে সৃজনের স্বাধীনতা। শিল্পী কাকে নিয়ে লিখবেন, কী ভাষায় বলবেন, কোন ছন্দে বা কোন রঙে প্রকাশ করবেন—এই সিদ্ধান্ত একমাত্র শিল্পীর। এই সৃজনক্ষমতা যদি বাইরের দৃষ্টিভঙ্গি, প্রতিষ্ঠান, সমাজের অনুমোদন বা সেন্সরের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে তা আর শিল্প থাকে না—তা হয়ে যায় প্রপাগান্ডা বা সামাজিক যন্ত্রচালিত ‘উৎপাদন’।
এ প্রসঙ্গে বব ডিলান বলেন:
A man is a success if he gets up in the morning and goes to bed at night, and in between he does what he wants to do.
শিল্পে এই ‘what he wants’–এই চাওয়াটিই শিল্পীর অধিকার। শিল্পে ব্যক্তির অধিকার—অর্থাৎ শিল্পীর নিজের অনুভব, দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতার উপস্থিতি—শিল্পকে প্রাণ দেয়। আর যখন শিল্প থেকে সেই ব্যক্তি অনুপস্থিত বা নিস্পৃহ হয়ে পড়ে, তখন তা নিছক কারিগরি চর্চায় রূপ নেয়, যা হয়তো নিখুঁত হতে পারে, কিন্তু হৃদয় ছুঁয়ে যেতে ব্যর্থ হয়।
‘শিল্পে অধিকার’ প্রসঙ্গে অনেকেই শিল্পীর দক্ষতার প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন। আসুন এ বিষয়ে টলস্টয় কী বলেছেন শুনি।
টলস্টয় বলেছেন,
Art is not a handicraft, it is the transmission of feeling the artist has experienced.
টলস্টয়ের মতে, শিল্প এমন কিছু নয় যা নিছক দক্ষতা দিয়ে তৈরি করা যায়। এটি তখনই সত্যিকার অর্থে শিল্প হয়ে ওঠে, যখন এতে শিল্পীর নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির আন্তরিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ব্যক্তির অনুভব যদি তাতে অনুপস্থিত থাকে, তবে তা “শিল্প” না হয়ে শুধু “কাজ” হয়।
এ প্রসঙ্গে পাবলো পিকাসো’র নিচের উক্তিটি লক্ষ্য করুন:
The purpose of art is washing the dust of daily life off our souls.
এখানে ‘ধুলা’ মানে হলো একঘেয়েমি, ক্লান্তি, যান্ত্রিকতা। শিল্প যদি আত্মাহীন হয়—শিল্পীর ব্যক্তিক সত্তা থেকে বিছিন্ন হয়—তাহলে তা আর আত্মার ধুলা ঝেড়ে ফেলতে পারে না। কেবলমাত্র আত্ম-সম্পৃক্ত শিল্পই মানুষের অনুভূতিকে আন্দোলিত করতে পারে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তিটিও প্রাণিধানযোগ্য এ প্রসঙ্গে:
সুন্দর সেই, যা হৃদয়ের মধ্য দিয়া হৃদয়ে পৌঁছায়।
রবীন্দ্রনাথ এখানে বলছেন, হৃদয়হীন কিছু কখনোই সুন্দর হতে পারে না। অর্থাৎ, কোনো শিল্প তখনই সৌন্দর্যময় হয়, যখন তা হৃদয়ের অন্তর থেকে সৃষ্টি হয়ে অন্যের হৃদয়ে পৌঁছায়। যদি তাতে শিল্পীর ব্যক্তি-অভিজ্ঞতা না থাকে, তবে তা আত্মকেন্দ্রিক নয়—বরং নিষ্প্রাণ হয়ে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কথিত এই আত্মিক সংযোগ গড়ে তোলার জন্য শিল্পীকে প্রবেশ করতে হয় নিজের ভেতর, নিজের অনুভব ও প্রশ্নের গভীরে। রেইনার মারিয়া রিলকে তাঁর চিঠিতে এক নবীন কবিকে উপদেশ দিয়ে লিখেছিলেন, “Go into yourself. Find out the reason that commands you to write” (Letters to a Young Poet, Rilke, 1929)। আত্মসন্ধানহীন শিল্প শুধুই বাহ্যিক অনুশীলনে সীমাবদ্ধ থেকে যায়—কখনোই সময় অতিক্রম করে সকলের শিল্প হয়ে উঠতে পারে না।
যখন শিল্পে কোনো ব্যক্তির অধিকার বা অংশগ্রহণ থাকে না—অর্থাৎ, শিল্পী যদি কেবল বাহ্যিক নিপুণতায় বা জনপ্রিয় অনুকরণে কাজ করেন—তাহলে তা আত্মকেন্দ্রিক নয়, বরং একরকম “শূন্য আত্মবিশ্বাসহীন প্রয়াস” হয়ে পড়ে। তাতে প্রাণ থাকে না, তাড়না থাকে না, স্পর্শ থাকে না।
শিল্প কেবলমাত্র তখনই জীবন্ত হয়, যখন তাতে একজন মানুষের আত্মা, অভিজ্ঞতা ও আকুলতা মিশে থাকে। আর সেই সত্তাটিই পরে, বিশেষ থেকে নির্বিশেষ হয়ে, সকলের অনুভব হয়ে ওঠে।
২. কবিতার পাঠ ও বিশ্লেষণ: ‘অহিদ কাক্কুর বাঁশি এখনো বাজে’
কোনো একটি শিল্প কী করে বিশেষ থেকে নৈর্ব্যক্তিকতায় (particular to universal) উত্তীর্ণ হয়, তা দেখানোর জন্য উদাহরণ হিসেবে আমি এখানে কাজী দীন মুহম্মদের ‘অহিদ কাক্কুর বাঁশি এখনো বাজে’ কবিতাটি বেছে নিয়েছি। উপরের তাত্ত্বিক আলোচনার ভিত্তিতে আমরা দেখব—একটি নিখাদ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কীভাবে এক বৃহত্তর অস্তিত্বের বোধে রূপান্তরিত হতে পারে।
চলুন, সর্বাগ্রে ‘অহিদ কাক্কুর বাঁশি এখনো বাজে’ কবিতাটি পাঠ করে নিই:
কত কিছু ভুইলা যাই, অহিদ কাক্কুরে মনে করতেও কষ্ট হয়
তবু তাঁর বাঁশি এখনো বাজে, শুনতে পাই। ইন্দিরার উপরে
আবছায়া অহিদ কাক্কু, তাঁর হাটুর সাথে ভাঁজ হয়ে থাকে
জীবনের বিস্বাদ, আর বাঁশি বাজে
আমরা যারা পড়ার টেবিলে; পড়তে ভুলে যেতাম
আমাদের বাবা চাচা মামা বিষণ্ণ কিংবা বিরক্ত হয়ে
আলিঙ্গন আলগা হয়ে গেলে আমাদের চাচি আম্মা
ঘুম ভেঙ্গে একগ্লাস পানি খান, তিরতির কাঁপে দরজার খিল
যে জীবন ছেড়ে আসি, তার পরতে পরতে সুর
যে জীবন পরে থাকি, হাত উঁচালেই
তার বগলের দিকটায় ছেঁড়া। অনাগত অর্কেস্ট্রার জন্য
সমবেত হতে হতে, সিদ্ধেশ্বরীর গলি ঘুপচিতেও
শুনতে পাই অহিদ কাক্কুর বাঁশি, এখনো বাজে
প্রথম স্তর: ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ
কবিতার শুরুতে কবি ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণায় নিমগ্ন:
“অহিদ কাক্কুর বাঁশি এখনো বাজে
কত কিছু ভুইলা যাই, অহিদ কাক্কুরে মনে করতেও কষ্ট হয়”
এখানে ‘অহিদ কাক্কু’ একটি স্পষ্ট, স্থানিক ও ব্যক্তিগত চরিত্র। এটি সম্ভবত কবির শৈশব বা পূর্বজীবনের কেউ — পরিচিত, ঘনিষ্ঠ, গ্রামীণ বা পাড়ার এক বাদ্যযন্ত্র বাজানো মানুষ। এই অংশে রয়েছে nostalgia বা স্মৃতিকাতরতা।
দ্বিতীয় স্তর: পারিবারিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট
এরপর ব্যক্তিগত চিন্তা পরিবার ও সমাজের বৃহত্তর পরিসরে প্রবিষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। কবিতা ধীরে ধীরে বৃহত্তর পারিবারিক পরিবেশে চলে আসে:
“আমরা যারা পড়ার টেবিলে; পড়তে ভুলে যেতাম
আমাদের বাবা চাচা মামা বিষণ্ণ কিংবা বিরক্ত হয়ে
আলিঙ্গন আলগা হয়ে গেলে আমাদের চাচি আম্মা
ঘুম ভেঙ্গে একগ্লাস পানি খান…”
এখানে কবি ব্যক্তিগত স্মৃতি থেকে পাঠককে নিয়ে গেছেন এমন এক জগতে, যা বহু পরিবারের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলে যায়-পড়তে না চাওয়া শিশু, অভিভাবকদের বিরক্তি, ঘুম ভেঙে জল খাওয়া মা। এই মুহূর্তে কবিতা কেবল কবির নয়—পাঠকেরও হয়ে ওঠে।
তৃতীয় স্তর: অস্তিত্ববাদী রূপান্তর
“যে জীবন ছেড়ে আসি, তার পরতে পরতে সুর
যে জীবন পরে থাকি, হাত উঁচালেই
তার বগলের দিকটায় ছেঁড়া।”
এখানে কবিতা অস্তিত্ববাদী ও দার্শনিক রূপ নেয়। আমরা আর শুধু ‘অহিদ কাক্কু’ বা ‘পড়ার টেবিল’-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নই। এখন আমরা সেই প্রান্তিকতা, অতীতচ্যুতি, এবং ছেঁড়াফাড়ার জীবনকে উপলব্ধি করছি — যা সব মানুষের অভিজ্ঞতায় মেলে।
চূড়ান্ত স্তর: প্রতীকী ও নৈর্ব্যক্তিক উপলব্ধি
“সমবেত হতে হতে, সিদ্ধেশ্বরীর গলি ঘুপচিতেও
শুনতে পাই অহিদ কাক্কুর বাঁশি, এখনো বাজে”
এখানে ‘অহিদ কাক্কু’র বাঁশি এক অনবদ্য প্রতীক হয়ে ওঠে—হারিয়ে যাওয়া শৈশব, হারানো জীবন, স্মৃতির সুর, অথবা প্রান্তিক অস্তিত্বের এক অবিনশ্বর প্রতিধ্বনির। এটা কেবল কবির নয় — যে কেউ এই সুর শুনতে পারে নিজের গলির মোড়ে, নিজস্ব স্মৃতিতে।
৩. শিল্পের রূপান্তর এবং কবিতার সফলতা
শিল্পের প্রকৃত শক্তি নিহিত থাকে তার এই ক্ষমতায়—সে নির্দিষ্ট কোনও স্থান, ব্যক্তি, বা অভিজ্ঞতাকে এমনভাবে উপস্থাপন করে, যা আমাদের চেনাজানা গণ্ডির বাইরে গিয়েও হৃদয়ে অনুরণন তোলে। কাজী দীন মুহাম্মদের কবিতা ‘অহিদ কাক্কুর বাঁশি এখনো বাজে’ সেইধরনেরই এক শিল্পকর্ম, যা স্থানিক ও ব্যক্তিক অভিজ্ঞতার গণ্ডি পেরিয়ে সর্বজনীন মানবিক বোধকে স্পর্শ করে।
এই কবিতায় ‘অহিদ কাক্কু’ নামের এক স্থানীয়, প্রান্তিক মানুষের প্রতিচ্ছবি আঁকা হয়েছে। তিনি শুধু একজন বাঁশিওয়ালা নন, বরং একটি সময়ের প্রতিনিধি—একটি গ্রামীণ সংস্কৃতির, এক ধরণের সহজ-সরল জীবনের স্মারক। তাঁর বাঁশির সুর শুধু এক ব্যক্তির নয়, বরং এক সমষ্টিগত অনুভূতির ধ্বনি, যা আমাদের সকলের মধ্যেই কোথাও না কোথাও প্রতিধ্বনিত হয়।
নির্দিষ্ট এই চরিত্রটি যখন কবিতায় উঠে আসে, তখন আমরা তার মধ্যে দেখতে পাই আমাদের নিজেদের হারিয়ে যাওয়া শিকড়, আমাদের শৈশব, আমাদের গ্রামীণ জীবনের নিঃসঙ্গতা এবং মাটির গন্ধ। এই অভিজ্ঞতা ব্যক্তিগত হলেও, কবি এমনভাবে ভাষা ও চিত্রকল্পের মাধ্যমে তা উপস্থাপন করেন, যে তা এক ধরণের ঐক্যবদ্ধ মানবীয় অভিজ্ঞতায় রূপ নেয়।
শিল্প যখন নির্দিষ্ট থেকে সর্বজনীনতায় উত্তরণ করে, তখনই সে কেবল সৌন্দর্য নয়, এক অন্তর্নিহিত মানবিক সত্যকে উদ্ভাসিত করে—যে সত্য ব্যক্তি-অভিজ্ঞতার সীমা ছাড়িয়ে সকলের অনুভবের জায়গায় পৌঁছে যায়। ‘অহিদ কাক্কুর বাঁশি এখনো বাজে’ কবিতার বাঁশির সুর তাই শুধু এক গ্রামীণ বাঁশিওয়ালার নয়, বরং এক বিস্মৃত মানবিক সুর, যা আমাদের অস্তিত্বের গভীরে নাড়া দিয়ে যায়। আমরা যেন সেই সুরে একসাথে শুনি হারিয়ে যাওয়া সময়ের ছায়া, অনুভব করি এক গোপন নস্টালজিয়া, আর খুঁজে ফিরি সেই অনুপস্থিত অথচ চিরপরিচিত কিছু—যা ছিল, আবার নেই, তবু আমাদের মধ্যেই থেকে যায়।
এভাবেই কাজী দীন মুহাম্মদের এই কবিতা নির্দিষ্ট এক অভিজ্ঞতার ফ্রেমে থেকেও সর্বজনীন এক বোধের দিকে নিয়ে যায় পাঠককে।
আর শিল্পের প্রকৃত তাৎপর্য সেখানেই—সে আমাদের ব্যক্তি অভিজ্ঞতাকে ছাড়িয়ে বৃহত্তর মানবিক পরিসরে পৌঁছে দেয়। শিল্প যখন নিজের মর্মকে ধারণ করেও, অন্যের আত্মায় প্রবেশ করতে পারে—তখনই সে হয়ে ওঠে জীবন্ত, সর্বজনীন, এবং চিরন্তন। কাজী দীন মুহম্মদের কবিতাটি এই উত্তরণের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, শিল্পসততা ও রূপক বিন্যাসের মাধুর্য্যে তা বিশেষ থেকে নির্বিশেষে উত্তীর্ণ হয়ে, হয়ে উঠেছে সকলের অভিজ্ঞতা।

নেশা: লেখালেখি। পেশা: ওয়েব ডিজাইনার ও ডিজিটাল মার্কেটিয়ার। ঢলভাঙা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত।
দোস্ত তুরে কল দিমু, তুই পইড়া আমারে শুনাইছ কারণ আমার পড়ার ধৈর্য্য নষ্ট হয়ে গেছে তবে বিষয়টি জানার প্রবল ইচ্ছা….
সব বুইঝাও না বোঝার ভান ধইরা থাকো তুমি দোস্ত! বুঝি না মনে করছো?